ডিগবাজি সাহেবের ইচ্ছাপূরণ
রাতে ডিগবাজি সাহেব বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘুম আসছে না। স্ত্রীর জন্য অনেকক্ষণ হল অপেক্ষা করছেন। তিনিও আসছেন না। ক'দিন হল একটু অন্যরকম আচরণ করছেন ডিগবাজি সাহেব।
স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এলো, কাল সকালে কি খাবে।
কণ্ঠে মধু নেই। আবার ঝাঁঝ যে আছে তাও বলা যাবে না।
ডিগবাজি সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন সকালে কি খাওয়া যায়। জবাব না পেয়ে স্ত্রী বেডরুমেই চলে এলেন।
ডিগবাজি সাহেব আর তার স্ত্রীর পরিচয়টা দিয়ে নেয়া দরকার।
ডিগবাজি সাহেব খুব নীতিবান মানুষ। কেন যে বাবা তার নাম ডিগবাজি রেখেছিলেন তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তার স্ত্রী অবশ্য মনে করে শিশুবয়সে স্বামী ডিগবাজি দিতে খুব পছন্দ করতেন। ডিগবাজি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সবাই এটা ঠিকমত পারে না। ছেলের ডিগবাজি দেয়ার স্ট্যামিনায় মুগ্ধ হয়ে বাবা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন ডিগবাজি।
ডিগবাজি সাহেবের স্ত্রী খুব একটা সুন্দরী নন, আবার কুৎসিতও নন। ডিগবাজি সাহেবের সাথে বেশ মানানসই বলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি খুব ভালো মানুষ। স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করতে করতে ক্লান্ত তিনি।
- কই সকালে কি খাবে বললে না তো?
- হুম তাই ভাবছি। আমি আমার লিডারের আদর্শের বাইরে যেতে পারি না। তিনি কৃষকের সাথে পান্তাভাত খেতেন। মেহনতি মানুষের সাথে মিশে যাওয়াই ছিল তার আজন্ম সাধনা। পান্তাভাতের ব্যবস্থা কর। কাল থেকে প্রতিদিন সকালে পান্তাভাত খাবো আমি। বৈজ্ঞানিকরাও এখন বলছেন পান্তাভাত অনেক উপকারী।
ডিগবাজি সাহেবের স্ত্রী অবশিষ্ট ভাতে পানি ঢেলে গত সপ্তাহে স্বামীর উপহার দেয়া অর্ধস্বচ্ছ মসলিনের নাইট-গাউনটি পরে নিলেন। গ্রীষ্মের রাতে ওটা বেশ আরামদায়ক। তবে বেডরুমে নয়, রিডিংরুমে গেলেন। পড়াশোনা, লেখালেখি তার খুব পছন্দ। প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। এদেশের জে কে রাউলিং বলা যায় তাকে।
তাদের বিয়ে হয়েছে বেশ কয়েকবছর হল। কিন্তু কেন যেন দেখে মনে হয় দু'মাস আগে বিয়ে করেছে। সকালবেলা বিছানা ছেড়ে উঠে ডিগবাজি সাহেবের স্ত্রী খুব শখ করে পান্তা ইলিশ আয়োজন করলেন। স্বামীর সাথে বসে খাবেন বলে অপেক্ষা করছেন।
ডিগবাজি সাহেব খাবার টেবিলে এসে কিছুক্ষণ ঝিমোলেন। এরপর ২৭ বছরের আগের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যার কথা স্মরণ করলেন, যেদিন তার লিডার লেবু চা খেতে খেতে বলেছিল, বুঝলে ডিগবাজি, চালের ওপর চাপ কমাতে হলে আমাদের অবশ্যই গমের আটার রুটি খাওয়ায় অভ্যস্ত হতে হবে। অন্তত সকালবেলা আমাদের রুটি খাওয়া উচিত। আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন এদেশের মানুষ সকালবেলা খুশি-মনে রুটি খাবে।
এবার ডিগবাজি সাহেব মুখ খুললেন।
- বউ রুটি বানাও। রুটি খাবো। এটা আমার নেতার স্বপ্ন ছিল।
- তুমি না বললে আজ পান্তাভাত খাবে। আমি এত আশা করে পান্তা ইলিশ খাবো বলে বসে আছি।
- তুমি খাও। আমার নেতার স্বপ্ন ছিল রুটি খাওয়া। আমি আমার আদর্শের বাইরে যেতে পারবো না।
ডিগবাজি সাহেবের স্ত্রীর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মন খারাপ হলেও কেউ বুঝতে পারে না। তিনি রুটি বানানোর আয়োজন শুরু করলেন। ছুটির দিন তাই ডিগবাজি সাহেবের তাড়া নেই। তিনি পত্রিকা নিয়ে বসে পড়লেন। টেলিভিশনটাও চালু। হাতে মোবাইল ফোন নাড়তে শুরু করলেন। কেবল স্ক্রল করে যাচ্ছেন। কোন কিছুতেই মন নেই। এভাবে আধা ঘণ্টা কেটে গেল।
স্ত্রী আবার ডাকলেন।
- এসো রুটি খাবে।
- না আজ পরোটা খাবো। আমার লিডার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি ঘিয়ে ভাজা পরোটা খুব পছন্দ করতেন। লিডারের পছন্দই আমার পছন্দ। লিডারের চেতনাই আমার চেতনা।
কেন যেন স্বনির্ভর স্ত্রী এবারও হজম করে গেলেন। তিনি পরোটার আয়োজন শুরু করলেন।
এ সময়টায় ডিগবাজি সাহেব বইয়ের তাক থেকে একটা বই নামিয়ে পড়তে শুরু করলেন, আল কিতাব আল ভেতো বাঙালি।
স্ত্রী পরোটা তৈরি করে আনার পর ডিগবাজি সাহেব বলেন। এই কিতাব আমাদের সবাইকে মানতে হবে। এখানে স্পষ্ট করে বলা আছে আমাদের ভাত খেতে হবে। আমাদের হট এন্ড হিউমিড ওয়েদারে ভাত খাওয়া ফরজে আইন।
ভাত রান্না এমন কোন কঠিন কাজ নয়। ডিগবাজি সাহেবে স্ত্রী চুলোয় ভাত বসিয়ে সদ্য তৈরি করা পরোটা খেয়ে নিলেন।
এবারও ডিগবাজি সাহেব ভাত খেতে রাজি হলেন না।
- কিতাবে কি লেখা আছে তার অর্থ আমরা সবাই বুঝতে পারি না। এই দ্যাখো কিতাবের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞ ইউটিউব বক্তা চালনা চালপুরী স্পষ্ট করে বলেছেন স্রষ্টার নিয়ামত উপেক্ষা করা একটা জঘন্য অপরাধ। তিনি আমাকে তৌফিক দিয়েছেন ভালো খাওয়ার। তাহলে আমি কেন ভাত খাবো? তুমি পোলাও-কোর্মার ব্যবস্থা কর।
- ওটা দুপুরে খেয়ো। এখন ভাত খেয়ে নাও।
- না এটা হতেই পারে না। আমি খোদার হুকুমের বাইরে যেতে পারবো না।
- ওটা ইউটিউব বাটপারের বক্তব্য। খোদার হুকুম নয়।
- চোপ। স্রষ্টা নারাজ হবেন।
ডিগবাজি সাহেবের জন্য পোলাও-কোর্মাও এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু এবারও তিনি খেলেন না। কারণ ১৭ বছর আগে এক ইফতার মাহফিলে যোগ দিয়েছিলেন ডিগবাজি সাহেব; যেখানে ভুখা-নাঙাদের উপস্থিতি না থাকলেও সমাজের ওপরতলার অনেকেই ছিলেন। সেই ইফতার মাহফিলে লিডার বলেছিলেন মাঝে মাঝে উপোষ থাকা ভালো। এতে বঞ্চিত, মেহনতি মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা সহজ হয়। ডিগবাজি সাহেব আজ উপোষ থাকবেন ঠিক করেছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন